ছোটগল্প ‘উপেক্ষা’: অধ্যাপক জে. আলী

প্রথম প্রকাশঃ সেপ্টেম্বর ৩০, ২০১৯ সময়ঃ ১:৪৩ অপরাহ্ণ.. সর্বশেষ সম্পাদনাঃ ২:৪৬ অপরাহ্ণ

যদি প্রশ্ন করা হয় জগতের সবচেয়ে ভারী বস্তু কি?
সবাই এক বাক্যে উত্তর দেবে – “পিতার কাঁধে পুত্রের লাশ”। আমার উত্তরটা কিন্তু ভিন্ন- ভালোবাসার মানুষের কাছে উপেক্ষিত হওয়াও কম ভারী নয়। মাঝে মাঝে আমার নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে আসে। তাকিয়ে থেকেও চারপাশটা অন্ধকার দেখি, দেখি ঘোলাটে। প্রচন্ড শীতে পিছনের শিরদাঁড়া বেয়ে নেমে যায় নোনতা ঘামের বিন্দুগুলো। মনের অজান্তেই দীর্ঘশ্বাস নেমে যায় বুক খালি করে। পাশে দীর্ঘক্ষণ বসে থাকা মানুষটি আমার দিকে তখন তাকায় করুণার চোখে।
অনেকক্ষণ ডাকাডাকির পর ধ্যানমগ্ন মানুষের মতো চোখ তুলে যখন তাকাই, তখনই অপেক্ষমান মানুষটির চোখের বিরক্তি রেখা দেখতে পাই স্পষ্ট। শেষ আষাঢ়ের বড় বড় ফোটার বৃষ্টিতে কৃষ্ণচূড়ার কালচে লাল ফুলগুলো যেভাবে লুটিয়ে পড়ে থাকে রাস্তার ধুলোয়, ঠিক তেমনই নিজেকেও নিজের কাছেই অপ্রয়োজনীয়, অপাংতেয় মনে হয় মাঝে মাঝে। মনে মনে হাসি, কখনো কখনো সে হাসি ছড়িয়ে যায় ঠোঁটের কোণে। নদীর ঢেউয়ের মতো ধাক্কা লাগে গালে। মনের দুঃখে কখনোবা অট্টহাসিতে ফেটে পড়ি। হাসি থামলে দেখি চোখের কোণে এক বিন্দু জল। নিজের কূপমন্ডকতা, ধারাবাহিক আহম্মকির স্মৃতি মনে পড়তেই নিজেই নিজের আমসত্বের মতো চুপসে যাওয়া গালে পায়ের চটি খুলে মারতে ইচ্ছা করে চটাচট।
কাউকে সত্যিকারের ভালোবাসলে কষ্ট পেতে হয় সুনিশ্চিত, শুনেছিলাম অনেকের কাছেই কিন্ত আমলে নিইনি কখনও। ভালোবাসায় ছেকা খাওয়া বন্ধুদের কপালের ভাঁজ পড়া অবয়ব, বুকের কষ্ট গুলো গোপনে হজম করতে দেখে হেসেছি মনে মনে অনেকবার। বুক টান করে নিঃশ্বাস নিয়ে নিজেকে নিজেই বলেছি – এমনটা হবার নয়, আমি কি আর তেমন ছেলে!!!
আজ আমার কষ্ট আছে, শুধু নেই সেই বন্ধুরা। নেই কষ্টগুলোর ভাগ নেওয়া আপনজনদের কেউ। তাদের সবাইকে একে একে পর করেছিলাম ওর কারণেই। আর ওর সুখই যে ছিল আমার সুখ। আমি তো ছিলাম সবারই প্রিয়, আড্ডাবাজ, সদা হাস্যোজ্জ্বল, উচ্ছল এক যুবক। বন্ধুদের সাথে চূড়ান্ত মজা করতাম সুযোগ পেলেই। অথচ এক সময় লক্ষ্য করলাম, কাছের সব বন্ধুরা এক এক করে দূরে সরে যাচ্ছে যেমন করে ঢেউয়ের তোড়ে কচুরিপানাগুলো সরে যায় একে অন্যের কাছ থেকে। প্রথমে পাত্তা দেইনি, কারণ ওই তো ছিল আমার সুখ-স্বাচ্ছন্দ, ভালোলাগা – ভালোবাসা। বন্ধু-বান্ধবদের সাথে হঠাৎ দেখা হয়ে গেলে ও বিরক্ত হতো, তাই আমিও আগ্রহ দেখাতাম না। আর এখন ও চলে যাওয়ার পর বুঝতে পারছি এসবই ছিল ওর মাস্টারপ্ল্যান। আমাকে ইচ্ছে করেই ও বিচ্ছিন্ন করেছে সুবর্ণচরের মতই বাংলাদেশের মূল ভূখণ্ড থেকে।
ছাত্র জীবনের প্রথম পরাজয়ের ধাক্কাটা খেলাম সেদিন, যেদিন ডিপার্টমেন্টের হেড ডক্টর ইসানুর স্যার বিশ্ববিদ্যালয়ের ড্রপ আউটের চিঠিটা ধরিয়ে দিল হাতে। পরপর দুই সেমিস্টার পড়াশুনা কিছুই করিনি, মন ছিল না পাঠে। কারণ আমি তো আমাতেই ছিলাম না। আমি ভাসতাম সাদা কাশফুলের নদীতে, সাঁতার কাটতাম নীল সাগরের বুকে, আছড়ে পড়তাম চোখ বন্ধ করে। তাছাড়াও তো আমার ছিল অনেক কাজ; ওর অ্যাসাইনমেন্ট করে দেওয়া, শিক্ষকের দেওয়া রেয়ার বইগুলো কালেকশন করা, টিউটোরিয়াল ম্যাটেরিয়াল জোগাড় করা, রাত জেগে মার্কেটিং ম্যানেজমেন্ট এর নোট তৈরি করা, ওর বন্ধুদের কাছ থেকে দরকারি জিনিস গুলো সংগ্রহ করে সময়মতো ওকে পৌঁছে দেয়া।
একদিনের কথা দিব্বি মনে আছে- সেটা ছিল মাঘ মাসের শেষের কোন এক রাত।
রাতে প্রচন্ড শীত, আমার গায়ে জ্বর। ও ফোন করে বলল পরদিন ১২ টার মধ্যে প্রজেক্ট প্রপোজাল জমা দিতে হবে, এটাই লাস্ট ডেট। ওর জাদুমাখা কন্ঠের আবদারে আমার জ্বরের কথা ওকে বলারই সুযোগ পেলাম না। ও যে ফোন রেখে দিল নিশ্চিন্তে। বার কয়েক ভাবলাম ফোন করে বলি- আমার গায়ে প্রচন্ড জ্বর। কিন্তু বলতে পারলাম না, পাছে ও মনে কষ্ট পায়। জ্বর নিয়েই বাসা থেকে নামলাম। প্রচন্ড শীতে হাত পা অবশ হয়ে যাচ্ছে, সারারাত ছিলাম জ্বরের ঘোরে। ভোর কি ভোর না তা বুঝতে পারিনি, বুঝতে পারলাম রাস্তায় নেমে, তখনো আসলে ভোর হয়নি। রাস্তায় কোনো গাড়ি ঘোড়া নেই, নেই জনমানবের চিহ্ন। দূর থেকে একটা এ্যাম্বুলেন্সের হুইসেল শুনে রাস্তার পাশে সরে না গিয়ে হাত উঁচু করে দাঁড়ালাম অনুরোধের ভঙ্গিতে।
আমি কিছু বুঝে ওঠার আগেই অ্যাম্বুলেন্স আমার গা ঘেশে ব্রেক করল। হেলপার মাথা বের করে জানতে চাইলো- কি ভাই থামাইলেন কেন? যাবেন কই?
আমিও তড়িৎ জবাব দিই, নীলক্ষেত যাব। আমার ঘোরলাগা চোখের আকুতি ভরা দৃষ্টিতে আটকে গেল হেলপারের চোখ, ড্রাইভারের দিকে অনুমতির জন্য মাথা ঘুরিয়ে তাকাল। মৌন সম্মতি পেয়ে চোখের ইশারায় আমাকে উঠতে বলল পেছনে। আমিও সময় নষ্ট করলাম না, দ্রুত উঠে গেলাম অ্যাম্বুলেন্সে।
এম্বুলেন্সে উঠে বুঝতে পারলাম এ্যাম্বুলেন্স আসলে রোগী নিয়ে যাচ্ছে না, নিয়ে যাচ্ছে একটি লাশ। লাশের দুর্গন্ধে ভেতরটা আমার উলট-পালট হয়ে গেল । জ্বরের শরীর, টিকতে না পেরে হড়হড় করে বমি করে দিলাম লাশের গায়ে। আর কিভাবে আমাকে মহাখালী নামিয়ে দিল, তারপর কিভাবে আমি নীলক্ষেত গেলাম কোনটাই মনে নেই। শুধু মনে আছে তখনও ভোরের আলো ফোটেনি। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কর্মচারী আবাসিকের দিকে কিছু পাখি ডাকছে কিচিরমিচির, দূরে এক পাগল চটের ছালা পড়ে হাটছে খালি গায়ে। সিটি কর্পোরেশনের পরিচ্ছন্ন কর্মীরা সবে আসতে শুরু করেছে। আমি অসুস্থ শরীর নিয়ে শীতের প্রকোপ থেকে বাঁচতে সামনে এগিয়ে গেলাম- যেখানে দুজন রিকশাওয়ালা কিছু ময়লা কাগজ, রাস্তার খড়কুটো দিয়ে আগুন জ্বালিয়ে নিজেদের হাত পা গরম করছে। ওদের কাছে গিয়ে দাঁড়ালাম। দূর থেকে ডেকে নিলাম পাগলকেও। কেন যেন মনে হল ওর আর আমার অবস্থা একই, শুধু আমার গায়ে চটের ছালা জড়ানো বাকি আছে।
এ তো গেলো ছাত্রজীবনের পতনের উপাখ্যান। এবার বলি আমার পারিবারিক জীবনের দেউলিয়াত্বের ঘটনা। আমার স্পষ্ট মনে আছে, সামনে সেমিস্টার ফাইনাল। আশেপাশের বন্ধুরা সবাই যার যার মত পড়াশোনার ধান্ধায় ব্যস্ত। স্যারদের পেছনে দৌড়োদৌড়ি, নোট করা, হঠাৎই গ্রামের মধ্যে জেগে ওঠা সাপ্তাহিক হাটের মতো ব্যস্ত কর্মচঞ্চল আমার আশেপাশের সবাই।
আমার মন খারাপ। ভার্সিটি গিয়ে দেখি আমার নাম নোটিশ বোর্ডে ঝুলছে। পাশে আরো কয়েকজনের নাম। সাথে আছে আমাদের পাশের রুমের রুমমেট কাউসার। ও যে নেশাগ্রস্ত এটা আমাদের সার্কেলের সবাই কমবেশি জানে। আমার নাম দেখে ও মুচকি হেসে বলল- “কিরে সালেক তুই”। নিজেকে নিজের কাছে খুবই ছোট মনে হতে লাগলো। মনে হলো দূর থেকে যে ছেলেকে নেশার জন্য ঘৃণা করতাম আজ হেরে গেলাম তার কাছেও। ও কাছে এসে হাত ধরে বলল- “চল ডিপার্টমেন্ট হেডের কাছে যাই, কিছু করা যায় কিনা দেখি”। আমি ওর সাথে চললাম। যেহেতু আগে এমনটি কখনো হয়নি তাই ভাবলাম যদি পরীক্ষাটা অন্তত দিতে পারি। স্যার আমার দিকে তাকিয়ে কিছুটা অবাক হয়ে বললেন- তোমার পারিবারিক অবস্থা আমি তো ভালোভাবেই জানি। তোমার এত ডিউ কেন? ৯২ হাজার ৭০০ টাকা ডিউ। আমাকে নিরুত্তর দেখে স্যার কথা বাড়ালেন না, শুধু বললেন যাও পঞ্চাশ হাজার টাকা তিন দিনের মধ্যে ব্যবস্থা করে নিয়ে এসো, বাকিটা আমি দেখছি। আমি যেমন নিরবে কাউসারের সাথে স্যারের কাছে গিয়েছিলাম তেমনই নীরবে বেরিয়ে এলাম রুম থেকে। বাবাকে ফোন করে বললাম- বাবা টাকা লাগবে পঞ্চাশ হাজার। সময় কম, তিনদিনের মধ্যে পাঠাতে হবে নইলে সেমিস্টার ফাইনাল দিতে পারব না।
সিগারেটের আগুনে হঠাৎ পানি পড়লে যেমন করে দুর্বল একটা শব্দ হয়, বাবার কন্ঠ মোবাইলের ওপাশ থেকে তেমনটাই লাগলো।
মাসিক খরচের সাথে প্রতিমাসেই সেমিস্টারের ফি পাঠিয়ে দিই, জমা দাওনি তুমি? অসহায় ভাবে জানতে চাইল বাবা।
যে টাকা তুমি দাও তা দিয়ে কি ঢাকা শহরে খেয়ে-পরে চলা যায় ভালোভাবে? ঝাজের সাথে উত্তর দিলাম আমি। শুধু দীর্ঘশ্বাস ছাড়ল বাবা বুঝতে পারলাম।
তোমার মা তিনদিন ছিল হাসপাতালে, এখন বাড়িতে তবে পুরোপুরি সুস্থ হয়নি। আমাকে জানাওনি কেন? অপরাধীর মতো জানতে চাই আমি।
জানিয়ে কি লাভ বল!!! ইদানিং তুমি তো ফোন ধরার সময়ই পাও না। ধরলেও বল ব্যস্ত আছি পরে ফোন দেব। এই বলে কেটে দাও পরে ফোন করার সময় পাওনা। তোমার মা আর আমি অপেক্ষায় থাকি। তোমার মা জিজ্ঞেস করলে বলি- ছেলের সামনে পরীক্ষা, সেমিস্টার ফাইনাল। হয়তো ব্যস্ত আছে, পরে কথা বলবে।
সেবার বাবা আমাকে টাকা ঠিকই দিয়ে পাঠিয়েছিল পঞ্চাশ হাজার তিনদিনের মধ্যেই। কিন্তু আমার টিউশন ফি জমা দেওয়া হয়নি, দেয়া হয়নি পরীক্ষাও। হঠাৎ করেই প্ল্যানটা হয়ে গেল কক্সবাজার যাওয়ার, সাথে ওর মা। ওর মা আবার আমাকে ছাড়া যাবে না। আমি কি ওর মায়ের কথা ফেলতে পারি, উপেক্ষা করতে পারি। আর আমি কি তেমন ছেলে!!! এত থৈথৈ ভালোবাসা, আবেগ, উচ্ছ্বাস হঠাৎ করেই দমকা হাওয়ায় মিলিয়ে গেল। মেলাতে পারি না কিছুতেই। আমার জন্য নিজের হাতে ডিম ভুনা আর খিচুড়ি রান্না করে দাঁড়িয়ে থাকত টিফিন ক্যারিয়ার নিয়ে ঘন্টার পর ঘন্টা। ফেসবুক মেসেঞ্জারে রিপ্লাই দিতে এক মিনিট দেরি হলেও ফোন করে অভিযোগ করতো এত লেট রিপ্লাই কেন। কোন কারনে ফোন বিজি বা বন্ধ পেলে পাগলের মত একটার পর একটা মেসেজ দিতে থাকত ক্লান্তিহীনভাবে। আমার বাম হাতের উপর দুটো আঙুল আলতো করে রেখে গলায় আবেগ ঢেলে বলতো- এভাবে হাতে হাত রেখে কাটাতে পারব বছরের পর বছর। উচ্ছ্বাস নিয়ে বলতো আমার সাথে অ্যাাফেয়ার না হলে জগতের অনেক সৌন্দর্য অদেখা, অধরা থেকে যেত ওর জীবনে। আমার মত সোলমেটই খুজছিল ও বুঝ হবার পর থেকেই। কিভাবে ভুলে যাই- সদ্য গোসল করা ওর ভেজা চুলের গন্ধ। রিকশায় বসে উষ্ণ আলিঙ্গনে বাম হাত বুকের কাছে চেপে ধরে ঘন্টার পর ঘন্টা হাওয়ায় উড়ে বেড়ানো।নন্দন পার্কের কৃত্তিম পানির ওয়েভে দুজন দুজনকে জড়িয়ে ধরে ক্লান্তিহীন উদগ্র কামনার আগুনে জ্বলে পুড়ে ছারখার হয়ে যাওয়া।
মেহেদি পাতার মতো আজ উপরে সবুজ ভেতরে আমার লাল রক্তক্ষরণ বইছে নিরন্তর।
অথচ ও আছে আগের চেয়ে উচ্ছল প্রাণবন্ত। যোগাযোগ নেই, তারপরও এফ বিতে ওর হাস্যোজ্জ্বল ছবিগুলো দেখি। ব্লক মারেনি তাই ম্যাসেঞ্জারের সবুজ বাতি জ্বলতেই বুঝি ব্যস্ত আছে চ্যাটিংয়ে অন্য কারোর সাথে। কোরবানির গরু কাটার ছুরি দিয়ে কেউ যেন আমাকে কাটছে নিরন্তর; চামড়া নয়, মাংস নয়, একেবারে কলিজা। কান গরম হয়ে যায়। প্রকৃতির দান অবারিত অক্সিজেন টান পড়ে শুধু আমার নিঃশ্বাসে। মনে হয় টি-শার্ট পড়ে বালিশে আধশোয়া হয়ে ভিডিও চ্যাট করছে অন্য কারো সাথে, ঠিক যেমনটি করত আমার সাথে বরাবরই। শুধু আমার হাই বা হ্যালো অযত্নে পড়ে আছে নীলচে হয়ে। খেয়াল করেনি বা সময় নেই বা আকাঙ্ক্ষার জায়গাটা নষ্ট হয়ে গেছে ওর দিক থেকে। নিজেই নিজের সাথে প্রতিজ্ঞা করি; আর না, এবার আমিই ব্লক মারব। তাছাড়া যার মনে আমার জন্য এতটুকুও জায়গা নেই, হাইবা হ্যালোর উত্তর দেয়ার সময় নেই, তাকে ফ্রেন্ড লিস্টে রেখে আমার লাভ কি? ফোন করব না বলেও সিদ্ধান্ত নিই, আবার নিজের অজান্তেই হাত চলে যায় ফোনের বাটনে। মনের মধ্যে গেঁথে থাকা নাম্বার অবচেতন মনে ডায়াল করে আবার চেতন মনে লজ্জায় কেটে দি রিং হওয়ার আগেই।
ফোনটা ধরার সময় নেই তার জানি অথবা গুরুত্বপূর্ণ কারো সামনে আছে ধরতে সংকোচ করবে। এ আশঙ্কায় বারবার ডায়াল করি, রিং হওয়ার আগেই কেটে দিই। একদিন দুই দিন টানা তিন চার দিন এভাবে কেটে যায়। ভাবি ও হয়তো আবার আমাকে ফোন করবে, কোন এক সময় মনে করবে। ফোনটা হাত থেকে নামাই না, বন্ধ করিনা, চার্জ জিরো হতে দিই না কখনো। যদি ও ফোন করে না পায়। আমার অপেক্ষার প্রহর শেষ হতে চায় না। বাঁধভাঙা জোয়ারের পানির মত নিজের সাথে যুদ্ধে হেরে গিয়ে ঠিকই সাত দিন পর আবার ফোন দিই আমি। আবার তার কন্ঠে বিরক্তি ফুটে ওঠে। আমার ফোন পেয়ে অত্যন্ত সূক্ষভাবে তার এড়িয়ে যাওয়ার চেষ্টা তীরের মতো বিঁধে। তারপরও ছাড়তে পারিনা। বারবার অপমানিত হতে ছুটে যাই ছ্যাচড়ার মতো তার কাছে।
আসলে বাস্তবতা এমনই। যদি কোন মেয়ে একবার বুঝতে পারে ছেলেটি তাকে পাগলের মত ভালবাসছে, সময় দিচ্ছে দিনের পর দিন, না চাইতে আকাশের চাঁদটা হাতে তুলে দিচ্ছে। যে কোন কিছুতেই হ্যাঁ, হবে, করে দিচ্ছি, আছে, সমস্যা নেই, এটা কোন ব্যাপারই না এই শব্দগুলো অধিক মাত্রায় ব্যবহার করে, তাহলে ভালোবাসার মানুষের সত্যিকারের গুরুত্বটা প্রেমিকার কাছে আর থাকেনা।
অথচ যদি সম্পর্কের শুরু হতেই বলতে পারতাম- সরি, এটা সম্ভব না, এটা হবার না, অসম্ভব, ভেবে দেখি, কি পাগলের মত বলছ, আজ না কাল হবে, আমার মনে হয় ঠিক হবে না, আমার দ্বারা সম্ভব না, এভাবে ভাবছ কেন? তাহলে আমার মূল্যটা দুই পয়সার আধুলির মত মূল্যহীন হতো না ওর কাছে। যদি ভাবতাম প্রেমিকা আছে, প্রেম ভালোবাসা আছ্ পাশাপাশি আছে পড়াশোনা, ক্যারিয়ার আছে, নির্দিষ্ট লক্ষ্য আছে, আছে বাবা মার স্বপ্ন। টাইমলি ক্লাস-পরীক্ষা, টিটোরিয়াল দেয়ার মত মানসিকতা তখন যদি থাকত তাহলে আজ ও চলে গেলেও এতটা বিপন্ন বোধ করতাম না। নিজের পায়ে দাঁড়ানোর মত একটা অবলম্বন থাকতো হয়তো। নিজেকে মনে হতো না ফুলের বাগানে অযত্নে বেড়ে ওঠা কোন আগাছা। আমার বাবা এলাকার গণ্যমান্য বুদ্ধিমান মানুষ। আমার দাদারও নাম ডাক আছে। আমি কিভাবে এতটা বলদ হলাম ভাবতে অবাক লাগে নিজের কাছেই। দুই টাকার ছাগলে লাখ টাকার গাছ কেমনে খাইলো বুঝে উঠতে পারি না।
ইদানিং মুখে রুচি নেই আমার, রাতে ঘুম হয় না। হাঁটছি কিন্তু হেঁটে কোথায় যাবো মনে হতেই হাটা থামিয়ে দেই। কেমন যেন খাপছাড়া হতাশায় নিমজ্জিত ক্লান্তিকর একটা জীবন আমার। বন্ধুদের কাছে শুনেছি হিরোইঞ্চিরা নেশা করতে না পারলে নাকি নাপিতের দোকেনের ফেলে দেওয়া ভাঙা নিজের হাত নিজেই কাটে। আমারও তেমনই হয় ব্লেড খুঁজি। কোন কিছুই ভালো লাগেনা আগের মত। মজা পাই না কোন কিছুতেই; না গান, না মুভি, না মোশারফ করিমের বাংলা নাটক।
হঠাৎই মনে হলো যমুনা ফিউচার পার্কে যাই। নির্মলেন্দু গুণের মেয়ে মৃত্তিকা গুণের “কালো মেঘের ভেলা” দেখে আসি যদি মনটা ভাল হয়। ইদানিং কোন সিদ্ধান্তই ঠিকভাবে নিতে পারিনা, দ্বিধাদ্বন্দ্বে ভুগি। তারপরও গেলাম ছবি দেখতে। হল থেকে বেরিয়েছি মাত্র। ছবির চরিত্রগুলো তখনও মাথায় ঘুরছে। আনমনে সামনে হাটছি। কপাল খারাপ হলে যা হয়। ভালো করে তাকিয়ে দেখি ও আড়ং থেকে বের হচ্ছে, সাথে মধ্যবয়সী এক পুরুষ। স্বামী না তবুও অক্টোপাসের মতো জড়িয়ে আছে স্বামীর মতোই। কানের কাছে আমার দেয়া আইফোন টেন ধরা। পরণে গত ঈদে আমার দেয়া আড়ংয়ের সেই ড্রেস। ও আমাকে দেখেনি। দেখলেও হয়তো না চেনার ভান করতো অথবা এড়িয়ে চলে যেত অন্য দশজন অপরিচিত মেয়ের মতোই। আমার কি হয়ে গেল জানিনা। এত ভরা মার্কেটে সবার সামনে পা থেকে নিজের চটি খুলে চটাচট মারলাম গালে। আশে পাশের সবাই গালে চটি মারার শব্দ শুনে চমকে দাঁড়ালো। কেউ জিজ্ঞেস করল না সাহস করে, কেন নিজেই নিজের গালে চটি মারলাম এভাবে।

জে. আলী
সহযোগী অধ্যাপক ও বিভাগীয় প্রধান
দি ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি অব স্কলার্স।

আরো সংবাদঃ

মন্তব্য করুনঃ

পাঠকের মন্তব্য

সর্বাধিক পঠিত

20G